শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪২ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : খুলছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, আগামী ১২ নভেম্বর দেশের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের পর খুলে দেয়া হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। এর আগে ২ নভেম্বর হবে এ পথের ট্রায়াল রান। আর যাত্রী অপারেশনের প্রস্তুত নান্দনিক নির্মাণশৈলীর বিশ্বমানের চোখ ধাঁধানো আইকনিক রেলস্টেশন।
সোমবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে আইকনিক রেলস্টেশন পরিদর্শন করে রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের পর অল্প সময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হবে এই রেলপথে।
নতুন যুগের সূচনার অপেক্ষায় পর্যটননগরী কক্সবাজার। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ট্রেন যাবে এখন শুধু তার অপেক্ষা। আক্ষরিক অর্থে ঝিনুক না হলেও সমুদ্র দর্শনে এসে প্রথম দর্শনেই যেন সামুদ্রিক একটা আবহ পাবে কক্সবাজারে নির্মিত দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশনে। কেবল আসা-যাওয়ার জন্যই হয় না এই স্টেশন, দেয়া হয়েছে বহুমাত্রিক রূপ।
এখন চোখ ধাঁধানো আইকনিক স্টেশনটি দৃশ্যমান। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আইকনিক রেলস্টেশনটি নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে বিশ^মানের সব সরঞ্জাম। নানা জটিলতা পেরিয়ে পরিপূর্ণতা পেয়েছে ভবনটি। আর আইকনিক রেলস্টেশন দেখে সবাই মুগ্ধ আর প্রশংসা কুড়িয়েছে এডিবি’রও।
আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে আইকনিক রেলস্টেশনটি। আইকনিক ভবনটি নির্মাণ অত্যন্ত জটিল ছিল। যেমন যে স্টীলগুলো দেখা যাচ্ছে, এই স্টীলগুলোর না যত দাম এটা তৈরি করতে তার চেয়ে ৪ গুণ বেশি টাকা ব্যয় হয়েছে। সবমিলিয়ে আমরা টাকার দিকে থাকায়নি, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও সহযোগিতা করেছে।
ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, কক্সবাজারে নির্মিত আইকনিক রেলস্টেশনটি দেখে মুগ্ধ এডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা। তাদের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছে, এরকম সুন্দর ও নান্দনিক আইকনিক রেলস্টেশন বিশে^ আর কোথাও নেই। এটা দেখে অন্যান্য দেশেও এরকম আইকনিক ভবন নির্মাণ করবেন তা গর্বের সঙ্গে বলে গেছেন এডিবির কর্মকর্তারা।
এদিকে সোমবার বিকেলে আইকনিক রেলস্টেশন পরিদর্শনে আসে রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন। পরিদর্শনের শুরুতেই আইকনিক ভবনের ভেতরে ঢুকে চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে দো’তলায় উঠেন, এরপর যাত্রী সেবার কার্যক্রমগুলো সম্পর্ক অবগত হন। এরপর ঝিনুকের ফোয়ারা, প্ল্যাটফর্ম, গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানগুলো পরিদর্শন করেন। এসময় মন্ত্রীর সঙ্গে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো: সুবক্তগীন, সাবেক প্রকল্প পরিচালক মো: মফিজুর রহমান, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ৯২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ শেষ। যা ট্রলিযোগে পরিদর্শনও করা হয়েছে। আর আইকনিক রেলস্টেশনটিও অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রস্তুত। এখন শুধুমাত্র ফিনিশিং ও কিছু রঙের কাজ চলমান রয়েছে। এসব বাকি কাজগুলোও উদ্বোধনের আগে শেষ হবে।
রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, আগামী ২ নভেম্বর দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথে ট্রায়াল রান এবং ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন। আর উদ্বোধনের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই রেলপথে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হবে।
তবে কয়টি ট্রেন চলাচল করবে বা ভাড়া কত হবে তা বলেননি রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন।
এর আগে মন্ত্রী মোটর ট্রলিতে করে দোহাজারী থেকে নবনির্মিত এই রেলপথ পরিদর্শন করেন।
এসময় তিনি জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করা হবে ।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ধরে মাতারবাড়ীতে যে ডিপ সি পোর্ট করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সেটির সঙ্গে যুক্ত করব। কাজেই বহুবিধ ব্যবহারের জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথটি করা হচ্ছে।
দোহাজারীতে পরিদর্শন শেষে নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি দেখার জন্য এসেছি। আশা করছি ৩০ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রকল্পটির অবশিষ্ট কাজ শেষ হয়ে যাবে। দুয়েকটা স্টেশনের কাজ হয়ত বাকি থাকবে। তবে রেল চলাচলের জন্য উপযোগী হবে। আমরা মোটর ট্রলি করে এখান থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যাব।
তিনি বলেন, এখন মানুষ বিমানে-সড়ক পথে কক্সবাজার যায়। মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ট্রেনে করে কক্সবাজার যাবে। সারা দেশের মানুষের এই রেলপথ নিয়ে আগ্রহ ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা সব সময় সাশ্রয়ী নিরাপদ ও আরামদায়ক।
পর্যটকদের জন্য পর্যটন ট্রেন বা কোচ দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে উন্নত যাত্রীবাহী কোচ দেওয়ার উপযোগী করে কাজ করছি।
এর আগে সকালে কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ পরিদর্শনে যান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তখন রেলমন্ত্রী বলেন, কালুরঘাট সেতু অনেক পুরোনো। এই সেতু মেরামতের কাজ চলছে, যাতে কক্সবাজার রুটের ট্রেন নিরাপদে চলতে পারে। সেতুর ওপর ১৫ টন মিটারগেজ ইঞ্জিনের ট্রেন আগামী ৩০ বছর ঝুঁকিমুক্তভাবেই চলতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের যে ইঞ্জিন সেটি ১২ টনের। আমরা জানি যে, এই সেতু অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এটার সক্ষমতা যাতে বাড়ানো যায়, সে কারণে আমরা প্রকল্প গ্রহণ করেছি। সংস্কারকাজ চলমান। এই ব্রিজটি বাদ দিয়ে নতুন একটি ব্রিজ কালুরঘাটে হবে। যেটি এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। আমরা আশা করছি, আগামী বছর নতুন সেতুর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ডাবল লেইন মিটারগেজ এবং ফোর লেইনের সড়ক থাকবে একই ব্রিজের ওপর। কাজেই সেটি না হওয়া পর্যন্ত এই ব্রিজটি যেন আমরা ব্যবহার করতে পারি, সেভাবেই এটি তৈরি করা হচ্ছে। ২ নভেম্বর আমরা এখানে আসব এবং ট্রায়াল রান করব। উদ্বোধনের পূর্বেই এই রেললাইনটি ভালোভাবে তৈরি হয়েছে কি না সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হতে চাই। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই এই ব্রিজের কাজ শেষ হবে। তবে ছোটখাটো কিছু কাজ থাকতে পারে। একই ব্রিজ দিয়ে ট্রেন যায়, যানবাহন চলাচল করে, মানুষও চলাচল করে। সেই পথচারীদের জন্য আমরা আলাদা করে একটা লেইন করে দিয়েছি। মূল ব্রিজের ভেতরে আসতে হবে না। এটি এর আগে ছিল না। আমরা আরও ৬ ফিট ওয়াকওয়ে করে দিয়েছি, সেটার কাজ শেষ হতে আরও এক-দুই মাস সময় লাগতে পারে। আগে মূল ব্রিজের কাজ শেষ হোক, এরপর ওয়াকওয়ের কাজ শুরু হবে। এটা নতুন একটা সংযোজন।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, এখন আমরা ব্রডগেজের ট্রেন চালাতে পারছি না। ধীরে ধীরে এগুলোকে ব্রডগেজে রূপান্তর করব।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের দূরত্ব ১৪৮ কিলোমিটার। আর দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। বর্তমানে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ রয়েছে। এই দোহাজারী থেকে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে বন, পাহাড় বেয়ে এবং নদীর ওপর দিয়ে এই রেলপথটির নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের নথির তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। পরে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেগা প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। পরে অর্থায়নসংক্রান্ত জটিলতায় বেশ কিছুদিন প্রকল্পটি থমকে থাকার পর ২০১৫ সালে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দোহাজারি-চকরিয়া এবং চকরিয়া-কক্সবাজার (লট-১ ও লট-২) এই দুই লটে চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসি (চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন) ও দেশীয় তমা কনস্ট্রাকসন্স কোম্পানি ২৬৮৮ কোটি টাকা এবং চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিইসসিসি ও দেশীয় ম্যাক্স কনস্ট্রাকসন্স ৩৫০২ কোটি টাকায় যথাক্রমে এক ও দুই নম্বর লটের কাজ পায়। পরে ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৭ সালে এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply